প্রতিটি মানব, মানবীর জীবনের এক অনিন্দ্য বাসনা হচ্ছে বিয়ে বা বিবাহ | বিবাহ নামক বন্ধনের মাধ্যমে মানুষ জীবনের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে নিজেদের জীবন যাপনের মানকে স্থানান্তরিত করে থাকে | যেখানে মানুষ সংসার নামক সামাজিকতায় স্বর্গীয় সুখ লাভ করে | অন্যদিকে, অপ্রিয় ও অনাকাঙ্খিত সত্য মৃত্যুকে এড়িয়ে চলতে যার পর নাই সর্ব চেষ্টাই মানবকূল করে থাকে অবলীলায় | কিন্তু অদ্যাবধি বিশ্ব ভ্রমান্ডের কেউই এই চরম সত্যকে ডিঙিয়ে যাওয়ার মতো উদাহরণ স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি |
সমসাময়িক বিশ্বের গগণ চুম্বী জনপ্রিয়তার অধিকারী মার্কিন পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসন এর মৃত্যুকে প্রলম্বিত করার প্রক্রিয়াকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে |
মাইকেল জ্যাকসন এর স্বপ্ন ছিল মৃত্যুকে চমকে দিয়ে ১৫০ বছর বেঁচে থাকার। এ জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রদক্ষেপই তিনি নিয়েছিলেন।এবার দেখা যাক মৃত্যু থেকে নিজেকে দূরে রাখার কি কি কৌশলের ধারস্থ হয়েছিলেন মিস্টার জ্যাকসন |
- যে কোন ধরনের ইনফেকশন থেকে নিজেকে সুরক্ষার জন্য তিনি কারও সঙ্গে হাত মেলানোর আগে হাতে দস্তানা ও জনসমক্ষে আসার আগে মুখে মাস্ক পরে নিতেন |
- নিজের শাররীক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য নিজের বাড়িতেই ২৪ ঘন্টা ১২ জন স্পেশাল ডাক্তার নিযুক্ত করেছিলেন। প্রতিদিন নিজের আপাদমস্তক চেক-আপ করিয়ে নিতেন স্ব নিযুক্ত বিশেষ মেডিকেল টিমের মাধ্যমে । প্রতিটি খাদ্য গ্রহণের পূর্বে ল্যাবরেটরিতে চেক করে নিতেন । শরীরচর্চার জন্য ১৫ জন ফিজিও নিযুক্ত রেখেছিলেন।
- কতিপয় মানুষকে দরকারি সময়ে অঙ্গ প্রদানের জন্য অর্থ দিয়ে নিজের মহলে রেখে দিয়েছিলেন। যাতে প্রয়োজনে কিডনি, ফুসফুস, লিভার, চোখ, অথবা অন্য কোন অঙ্গ বিকল হলে সঙ্গে সঙ্গে ট্রান্সফার করা যায় ।
- ২৫ শে জুন ২০০৯ উনার হার্ট অচল হতে শুরু করে। ১২ জন ডাক্তারের টিম নিরলস প্রচেষ্টা ও শহরের সমস্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর নিরলস প্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে মাত্র ৫০ বছর বয়সেই স্রষ্টার হুকুমে তাঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।
ধর্মীয় ও দার্শনিক মূল্যবোধে মৃত্যুকে কিভাবে বিশ্লেষণ করে দেখে নেই |
- মৃত্যু তো অবধারিত।। ”প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” -সূরা অাম্বিয়াঃ৩৫।
পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে,
- “প্রত্যেক প্রাণিকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তন করবে।” -সূরা আনকাবুতঃ ৫৭
- মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে। (জীবিতকালে) এ থেকেই তুমি টালবাহানা করতে।- সূরা ক্কাফঃ ১৯।
- বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে, অতঃপর তোমরা অদৃশ্য, দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন সে সব কর্ম, যা তোমরা করতে। – সূরা আল জুমুআ: ৮।
- বলুন! তোমরা যদি মৃত্যু অথবা হত্যা থেকে পলায়ন কর, তবে এ পলায়ন তোমাদের কাজে আসবে না। তখন তোমাদেরকে সামান্যই ভোগ করতে দেয়া হবে। -সূরা আল আহযাবঃ ১৬
- ”তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দুর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও। বস্তুতঃ তাদের কোন কল্যাণ সাধিত হলে তারা বলে যে, এটা সাধিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি তাদের কোন অকল্যাণ হয়, তবে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে, বলে দাও, এসবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। পক্ষান্তরে তাদের পরিণতি কি হবে, যারা কখনও কোন কথা বুঝতে চেষ্টা করে না।” – সূরা আন নিসাঃ ৭৮
- “আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়, আর যে মরে না, তার নিদ্রাকালে। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন, তার প্রাণ ছাড়েন না এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। – সূরা আজ জুআআ’রঃ ৪২
- “প্রত্যেক প্রাণিকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। – সূরা আল ইমরানঃ ১৮৫
- “প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” -সূরা অাম্বিয়া -৩৫।
- “জম্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীড় হায়রে জীবন নদে?” – মাইকেল মধূসুদন দত্ত।
- “মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।” — সমরেশ মজুমদার
- ”ভীরুরা মরার আগে বারে বারে মরে। সাহসীরা মৃত্যুর স্বাদ একবারই গ্রহণ করে।”- উইলিয়াম শেক্সপিয়র
- ”আমি মনে করি, মৃত্যু হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ উদ্ভাবন। এটি জীবন থেকে পুরোনো ও সেকেলে জিনিস থেকে মুক্ত করে।” – স্টিভ জবস
- ”বর্ষাকালে এখানে, শীত-গ্রীষ্মে ওখানে বাস করব – মূর্খরা এ ভাবেই চিন্তা করে। শুধু জানে না জীবন কখন কোথায় শেষ হয়ে যাবে “
– গৌতম বুদ্ধ
- ”মৃত্যু নিয়ে আমি ভীত নই। কিন্তু মরার জন্য তাড়াও নেই আমার। তার আগে করার মত অনেক কিছু আছে আমার।” – স্টিফেন হকিং
- ”মৃত্যুকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন ঈশ্বর! নইলে মৃতদের সকল দায় নিজের কাঁধে নেবেন কেন?”
– এজি মাহমুদ
যেতে যেতে এই বাস থেমে যাবে বকুল তলায় যাত্রীরা পড়বে নেমে যে যার মতন।”
– রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
সুতরাং তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে নিশ্চিন্তভাবে বলা যেতে পারে যে , মৃত্যু অবধারিত ও অলঙ্গনীয় | কিন্তু মজার বিষয় হল বহুল কাঙ্খিত বিয়ে ও সর্বোপেক্ষিত মৃত্যুর মাধমে জীবন স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে অবাক করা মেলবন্ধন |
বিবাহ এবং জানাযার মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে অমৃত ভাবনার খোরাক| একটু চিন্তা করে দেখি :-
- বিবাহে এক জনকে পালকিতে ওঠানো হয়, জানাজায় অন্যজনের লাশ খাটিয়ায় ওঠানো হয়।
- একজনকে গোসল করানো হয় চির বিদায়ের জন্য,আরেকজনকে গোসল করানো হয় নতুন জীবনের জন্য।
- একজন নিজে নিজে সাজে, আরেকজনকে সাজানো হয়।
- একজন নিজে কাপড় পরে, আরেকজনকে কাপড় পরানো হয়।
- একজন চলে স্বামীর ঘরে, আরেকজন চলে চিরস্থায়ী ঘরে।
- একজন হেটে যায়, আরেকজনকে নিয়ে যাওয়া হয়।
- বিয়ে বাড়ীতে মেহমানরা সমবেত হয় বিদায় ও গ্রহণ উপলক্ষে , জানাজায় মানুষজন সমবেত হয় শুধু বিদায় জানাতে |
- বিয়ে বাড়ীতে বিদায় কালে কেউ আনন্দ করে কেউ কান্না করে, এখানেও বিদায় কালে কেউ কান্না করে কেউ আনন্দ করে। মৃত ব্যক্তি মুত্তাকী হলে, তাঁকে ফেরেস্তারা আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যান, তাঁকে স্বাগত জানান।
- বিয়ে বাড়ীতে মাওলানা,জানাযাতেও মাওলানা।
- সেখানে বিয়ে পড়ানো হয়,এখানে জানাযা পড়ানো হয়।
- একজনকে আপন করে নেওয়া হয়, আরেকজনকে দাফন করে দেওয়া হয়।
- বিয়ের পর নতুন জীবনের শুরু, কবরে আসল জীবনের শুরু।
- বিয়ে করে কেউ সুখী হয়,কবরেও কেউ সুখী হয়।
- বিয়ে করে কেউ দুঃখী হয়,
কবরেও কেউ দুঃখী হয়। (এই দল থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই)
মৃত্যুর চিন্তা নেই, গোনাহের অনুশোচনা নেই। মন চায় নামাজ পড়ি, কিন্তু শরীর মসজিদে যেতে চায় না। দুনিয়ার জাঁকজমকে দিশেহারা সময় এমনিতে শেষ করছি। একদিন সহসা অন্ধকার নেমে আসবে, চোখ যখন খুলবে তখন নিজেকে কবরে আবিষ্কার করব।
তখন প্রশ্ন করা হবে, কি নিয়ে এসেছ? কবরের নির্জন নীরবতা – অন্ধকারে একা – অনেক ভয় হবে – চিৎকার শুরু হবে।
কিন্তু কই? কেউ নেই।