সময়ের সমষ্টিগত প্রাণের সঞ্চারই জীবন । এই জীবনকে জীবন দান করতে গিয়েই আমরা হারিয়ে ফেলি অমূল্য জীবনের প্রকৃত মূল্যমান । আমি অন্তত আমার এ যাবৎ কালের জীবনের মূল্যায়নে তাই মনে করছি। নানান জনের নানান মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক । সবার মতের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল এই অধম ।
প্রায় তিন যুগেরও বেশী আমার এই জীবনে একাল ও সেকালের অভিজ্ঞতা হয়েছে ঢের । বলতে গেলে শতায়ু মানুষের মত না হলেও কাছাকাছি যে তাতে আমি নিশ্চিত । কত বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা যে আমাকে আবর্তিত করে আছন্ন করে আছে তা কেবল আমি আর বিধাতা ছাড়া তৃতীয় কেহই জানেনা । চাওয়া আর পাওয়ার সম্মিলন ঘটেনি বহু ক্ষেত্রেই । চড়াই উৎরাই আমাকে দেখিয়েছে জীবন কতটা অম্ল মধুর হতে পারে । সে ভাবনাগুলিই আজ আমাকে নিয়ে গেছে ভাবনার গভীরতম স্তরে ।
এত কথা কেন বলছি তার কিছু কারণ হয়তো লেখার কোন পর্যায়ে উত্তর মেলাবে । অন্তহীন ভাবনার মাঝে কখনই সীমাহীন পরপারের কি হবে তার উত্তর মিলেনি । কি অদ্ভুত এক মোহে বেমালুম উদাসীন হয়ে আছি স্থায়ী জীবনের কথা । এই অবস্থা মনে হয় আমার একার নয়। যাহোক , সৃষ্টি কর্তা সকলকেই সমান ভাবে নিজের জীবনকে উপভোগ করার ক্ষমতা ও অধিকার দিয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যখন গত বছর চীনে শুরু হয়েছিল তখন থেকেই মৃত্যু নিয়ে আমার গভীরতম ভাবনা শুরু হয় । ক্ষণে ক্ষণে সে ভাবনা পরিবর্তন হয়েছে করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে ।
প্রায়শই আমার চোখে সাদা কাপড়ে মুড়ানো লাশের চিত্র ভেসে উঠে । রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতিনিয়তই ভাবি কাল যদি লাশ হয়ে যাই তাহলে কি হবে ? প্রাণহীন আমাকে কে বা কাহারা দেখতে আসবে ? কেউ কি ভুলেও আমাকে মামুন বলে নাম ধরে ডাকবে ?বিলেতের প্রতিবেশীদের কেউতো আমার বাংলাদেশের ঠিকানাই জানেনা তাহলে আমার মৃত্যু পরবর্তী লাশের বন্দোবস্ত করেতে উনাদের কতইনা কষ্ট করতে হবে তা আল্লাহ মালুম ।
আমার মৃত্যুর খবরে সবচেয়ে বেশী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হবে আমার স্ত্রী কেয়া । কেননা সবকিছুর চেয়ে আমার উপরই তার একান্ত নির্ভরতা । আমাকে বিয়ে করে সে হারিয়েছে না বলা অনেক কিছুই।তার ভালবাসার প্রতিদান আমি দিতে পারেনি তা সত্যের চেয়েও অধিক সত্য । আমি নিশ্চিত সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে । এমনিতেই তার শরীরে বাসা বেঁধে আছে অনেক ব্যাধি । তার উপরে এই শোক সে কি বইতে পারবে? আহা বেচারির রোদনে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠবে ! সান্ত্বনা দিতে হয়তো অনেকেই এগিয়ে আসবে কিন্তু ততক্ষণে আমার শিশু মেয়ে দু’টোর কি হাল হবে তা ভাবতেই গা অবশ হয়ে আসে । সাদা শাড়ি পরিয়ে শেষ বারের মত আমার মুখ দেখাতে নিয়ে আসলে সে বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে নিমিষেই। যে মেয়ে দুটো আমার যক্ষের ধন তাদেরও তো অনেক কষ্ট হবে সে দিন, তাই না ? ছোট মেয়ে রাহাকে তো জন্মের পর এখনো ছুঁয়েই দেখিনি ! প্রায়ই মনে হয় দয়ার দরদে সে আমাকে বাবা বলে ডাকে । ছোট মানুষ হলেও সে উন্মাদ হয়ে যাবে পিতৃ শোঁকে। শোকাচ্ছন্ন পরিবেশে কম কথা বলা বড় মেয়ে বাঁধন থাকবে বাকহীন । কিন্তু সাদা কাপড়ে মুড়ানো খাটে শুয়ে থাকা আমার কিছুই করার থাকবে না । আহারে জীবন ! এইতো জীবন !
আমার মৃত্যুর দিন হরেক রকমের ঘটনা ঘটার পূর্বাভাস আছে । মূল ঘটনা ঘটবে জায়গা জমি বণ্টন সম্পর্কিত । অথচ এই জায়গার জন্য হারিয়েছি জীবনের অমূল্য কত কিছু যার মাশুল গুনছি প্রতি পহরেই । আমার আব্বাকে হেনস্তা করবে অনেকেই । ছোট মামার উপর দিয়েও একটা বিশাল চাপ যাওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না । তারপর কেয়ার (আমার স্ত্রী )যদি জ্ঞান ফিরে তাহলে জিজ্ঞাসাবাদের আরেক তা ধকল যাবে তার উপর দিয়ে । এবারও আমি নিশ্চিত সে কি বলবে না বলবে তার কোন হদিস নাই । কিন্তু একটা বিধবা নারীর সাথে এতিম মেয়ে দুইটার মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিবে কি তাতে সন্দেহ আছে ! মামার বাড়িতে বেড়ে উঠার কারনে গ্রামে আমার কোন বন্ধু মহল নাই । কেউ মনে রাখবে কি না তার নিশ্চয়তা খুবই ক্ষীণ। আম্মা মারা গেছে প্রায় তিন বছর । কেউ ভুলেও আমার কাছে আম্মা সম্পর্কে জানতে চায়নি। তাই আত্মীয় স্বজনের কেউ খুঁজ নিবে কিনা তা বলা মুশকিল। বয়সের ভারে নূজ্য নানীটা নয়ন জলে বুক ভাসাবে তা সন্দেহাতীত ।
২০১৮ সালে আম্মা মারা যাওয়ার পরের দিন আমার বড় মেয়ে বাঁধন কে বলে রেখেছি আমার কবর কোথায় হবে । সম্ভব হলে দাদা, দাদী, চাচা ও মায়ের সারিতেই যেন আমাকে সমাধিত করে। যেখানে অল্প স্বল্প ঠাণ্ডাতেই আমার অবস্থা বেহাল হয়ে যায় সেখানে মাটির ঘর, বিছানাও মাটির , থাকব কি করে ? আল্লাহ তুমি রহম কর ।
জীবনে মনের কষ্ট কারো কাছে তেমন প্রকাশ করিনা । কেননা পরক্ষনেই নিজের বলা কথা নিজের প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। বাতিক্রম ঘটেছে দু একজন ক্ষেত্রে , যা আবার কনফ্লিকট অব ইন্টারেস্ট এর কারনে বহুরুপ দেখিয়েছে ।
হ্যাঁ, এক দম্পতির কথা বলে না রাখলে নেহায়েত অন্যায় হবে ।
তারা আবার কারা ?
রয়্যাল District greater নোয়াখালীর মানুষ উনারা ।
আইন পড়ার সাথী নাছরিন আপা ও উনার স্বামী মামুন ভাই
কেন তাদের কথা উল্লেখ করলাম ?
রক্তের সম্পর্কের বাইরেও যে স্বার্থহীন আত্মার সম্পর্ক হতে পারে তা উনাদের কাছ থেকেই শিখেছি।
লন্ডনের দুর্দিনে তারা যে আমাকে কি মূল্যায়ন করেছে তা না বললে বে ইনসাফ হবে।
আমি দৃঢ় ভাবে বলতে পারি উনারা আমার মৃত্যুতে অবর্ণনীয় মর্মাহত হবেন ।
করোনার আগ্রাসী ভূমিকায় অসহায় লাগছে সত্যিই । কিন্তু তদুপরি ডান হাতের জয়েন্ট এ সমস্যায় হাতটা প্রায় অচল। এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে হাতের অঙ্গুলি জনিত সমস্যা। বাম পায়ের আঙুল ফুলে যন্ত্রণা দিচ্ছে অবিরাম। বুকের ব্যাথাতো আছেই । কি হবে জানিনা তবে আজ না হয় কাল এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে প্রাকৃতিক নিয়মেই ।
আমার শহীদি মৃত্যুর জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। মৃত্যুর পরে আমার মাফিরাতের জন্য আপনাদের দোয়ায় সামিল রাখার বিনীত আরজ রইল । নিঃশর্তে ক্ষমা করে দিবেন সকল ভুল ভ্রান্তি ও আপারগতা ।